ভূ-রাজনীতির ডামাডোলে পাহাড়ে পোশাকি ঐক্যর ফেরিওয়ালারা বেশ সরগরম



প্রথমে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির দিকে একটু করে চোখ বুলিয়ে দেখি। অনেক দিন ধরেই বলাবলি হচ্ছে, বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসছে। ক্ষমতার ভর অনেকটাই বেইজিংয়ের দিকে সরে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে চীন অনেকটাই বিশ্বকে দখলে নিয়েছে। এখন সামরিক শক্তি প্রকাশের পালা। ভারতই চীনের আগ্রাসী সামরিক শক্তির প্রথম শিকার হতে পারে। হঠাৎ করেই যেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বদলে গেল। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি পুরোটাই কবজায় নেয় ভারত। এই অঞ্চলের রাজনীতিতে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করে চলতো। কিন্তু জঙ্গিবাদ, তালেবানসহ নানা সংকটে জড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র পাকিস্তান নিজেই এখন অস্তিত্ব নিয়ে লড়ছে।

ভূ-রাজনীতির ডামাডোলে পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত ঐক্যের ফেরিওয়ালারা মাঠে নেমেছে। মনে হয় যেন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের পক্ষে এদের অবস্থান। তাহলে আমি বলতে চাই, ঐক্যের পূর্ব শর্ত কি শুধুই ফেসবুকে চিল্লাচিল্লি করা? ফেসবুকে শুধুমাত্র ঐক্য-ঐক্য করে চিল্লাচিল্লি, চেঁচামেচি ও চিৎকার করলে ঐক্য হয় না, ঐক্য আসতে পারে না। ঐক্য চাইলে আগে ঐক্য-সমালোচনা-ঐক্য এই পদ্ধতি অনুসরণ করে সবাইকে এগুতে হবে। সেখানে যাওয়ার আগে আপনাদের বস্তু সম্পর্কে পূঙ্খানুপুঙ্খ করে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। বস্তুর অবস্থা, প্রকৃতি তার মধ্যে বস্তুর পারিপার্শ্বিক অবস্থা, বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বসমূহের সবদিক বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঐক্যের মনোভাব নিয়ে সমালোচনা করতে হবে। যেমন- অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতে ভুল এড়ানোর আন্তরিক হতে হবে। চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসা করেন সম্পূর্ণভাবে রোগীকে বাঁচানোর জন্যই-রোগীকে মেরে ফেলার জন্য নয়। একজন এপেন্ডিসাইটিস রোগে ভুগছে, এমন একজন ব্যক্তির তার উপাংগটি চিকিৎসক যদি কেটে দেন তখনই সে বাঁচে। কোন লোক ভুল করে, যদি সে চিকিৎসার ভয় না করে, রোগকে গোপন না রাখে, ভুলকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে না ধরে, সত্যি সত্যিই আন্তরিকভাবে চিকিৎসা করতে চায় ও ভুল শুধরাতে ইচ্ছুক থাকে তাহলে আমাদের উচিত তাকে স্বাগত জানানো ও তার রোগ সারানো। আমাদের চিন্তার মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার, চিন্তার মধ্যে ঐক্য নিয়ে আসতে পারলে সকল সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু ফেসবুকে ঐক্যের ফেরিওয়ালাদের কি এই মানসিকতা ও আন্তরিকতা আছে, আমি বলবো নেই।

Dhiman Wangzha দাদার ফেসবুক লেখাটি বেশ কয়েকবার পড়েছি এবং অনেক কিছু শিক্ষনীয় চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে আমাকে। তবে লেখার কিছু বিষয়ে আমার আপত্তি উপস্থাপন করলাম মাত্র। অন্য লেখকের মতন আপনি নন, উল্লেখযোগ্য কিছু বাক্য আমাকে বিষণভাবে পীড়া দিয়েছে। নিজ নিজ দল তথা কুঠরির সপক্ষে গুণগান গাওয়া এবং নিজ আদর্শের দলের নেতৃত্বেই জাতীয় মুক্তি আসবে এমন মনোভাবই কর্মীদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে প্রতীয়মান হচ্ছে বলে আপনি যে মন্তব্যটি করেছেন তা সত্যিই দুঃখজনক। তারপর ভবতোষ দেওয়ান সম্পর্কে বলতে গিয়ে জনসংহতি সমিতিকে নাজেহাল, অপমানিত করার অপবাদ চাপালেন এবং চুক্তির চূড়ান্ত পর্বে ছাত্র/যুব সংগঠনসমূহের প্রতিনিধি হিসেবে প্রসিত বিকাশ খীসাকে পার্টির তরফে চুক্তির সমুদয় প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার উদারতার প্রদর্শন করা আবশ্যক ছিল বলে যে মন্তব্য করেছিলেন তাও চলমান জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে বানচাল করার জন্য উষ্কে দেওয়ার বাক্যবান নয় কি? পার্বত্য চুক্তির প্রক্রিয়ায় কি করে প্রসিত বিকাশ খীসাকে যুক্ত করাবেন, সে অনেক আগে থেকেই চুক্তি বিরোধী চক তৈরি করে বসেছিলেন। প্রসিত বিকাশ খীসার বেলায় যে মন্তব্যটি করলেন তা সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক এবং বিচার, বিশ্লেষণ মোটেই বস্তুগত হয়নি।

আমি জানি না কোন অর্থে ভবতোষ দেওয়ানকে অপমান করা হয়েছে বলে আপনি বলেছেন। আমার যতটুকু জানা আছে, ভবতোষ দেওয়ানকে বরং যথাযথ সম্মান ও চিকিতসাসহ সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়েছিল। এত কিছু করার পরও ভবতোষ দেওয়ান কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে যাওয়ার পর এম এন লারমাদের উপর হামলার জন্য ম্যাপ এঁকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অবস্থান ও দিক নির্ণয় করে দিয়েছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তার ভিত্তিতে বিভেদপন্থী চক্ররা ১০ই নভেম্বর বিশ্বাসঘাতকতামূলক অতর্কিত হামলা চালিয়ে ৮ জন সহযোদ্ধা সহ মহাননেতা এম এন লারমাকে হত্যা করেছিল। কোন দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক ও বিভেদপন্থী ভবতোষ দেওয়ানের চাপাই গায়লেন আমার কাছে বোধগম্য নয়।

আরো দেখেছি S Chakma দাদার ফেইসবুকে সংবাদ সফর নামক আইডিতে প্রকাশিত লেখাটি বিরোধীতা করে উল্লেখ করেছেন যে, পাহাড়ের চার সংগঠনের প্রতি সংবাদ সফর নামক একটি আইডি থেকে একই গতানুগতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে যে কথার সারাংশ হল লাঠিও ভাঙবে না, সাপও মরবে না মতন একটি ডায়লগ।  সব দোষ নন্দঘোষ-সকল দলকে একই কাতারে ফেলা হচ্ছে। তার দৃষ্টিতে সবাই খারাপ কেহউ ভাল নয়, আপনাদের মূল্যায়নে এটি একটি বড় সমস্যা। আপনাদের এরকম মূল্যায়নের কারণে পাহাড়ের সমস্যা আরও অধিকতর জটিল হচ্ছে। একটি কথা আছে "সমাজ ধ্বংস হয় খারাপ মানুষের দ্বারা নয় বরং খারাপ কাজগুলোর ব্যাপারে ভাল মানুষের উদাসীনতার জন্য"। প্রথমে যারা সমস্যা শুরু করেছিল তাদের বিষয়ে কিছু ভাল মানুষ চুপ থাকার দরুনই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা আরও জটিল হতে জটিলতর হচ্ছে। মনে রাখবেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সবাই পাগলামি করছে না, সবাই শাসকদের লেজুড়বৃত্তি করছে না, সবাই ষড়যন্ত্র করছে না, সবাই কায়েমি স্বার্থ হাসিল করছে না, সবাই শাসকদের সাথে দালালীপনা করছে না। যারা নিঃস্বার্থ, সংগ্রামী, ত্যাগী তারা জাতির জন্য, সত্য ও ন্যায়ের জন্য প্রয়োজনে সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন, আছেন এবং আগামীতেও থাকবেন। আপনারা শুধুমাত্র একদেশদর্শী বিচার করার সংস্কৃতি চর্চায় ব্যস্ত আছেন, এধরণের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালে পুরো জাতিই লাভবান হবে।

ফেসবুকে ঐক্য ঐক্য করে অনেক ফেইক আইডি ও নামে-বেনামে জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতির উপর বিষ ঢালানোর অপচেষ্টা করে চলেছেন। আপনাদের লেখাগুলোতে অনেক মহান মানুষের সুন্দর সুন্দর উক্তি ও রাজনৈতিক তত্ত্ব আওড়ানোর পর এক পর্যায়ে এক-দুটো শব্দ কিংবা বাক্যের মধ্যে বিষ মিশিয়ে সমগ্র লেখাটি যেমনি বিষে পরিণত করেন তেমনি ঐক্যের বিপরীতে অনৈক্যের চোরাবালিতে পুরো জুম্ম জাতিকে ডুবিয়ে রাখার প্রয়াস চালান। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অতীতের বাস্তবতা কিছু টেনে আনতে আপনারা আমাকে বাধ্য করলেন। প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জীবিত অবস্থায় পার্টির মধ্যে ঘাপতি মেরে লুকিয়ে থাকা উপদলীয় চক্রান্তকারী, বিভেদপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমি অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামকে বানচাল করার ব্যর্থ অপপ্রয়াস চালিয়েছিলেন। জুম্ম জাতির মধ্যে সেদিন দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের আর্শিবাদপুষ্ট হয়ে এই চারকুচক্রী জনসংহতি সমিতি সংগঠন থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন। জুম্ম জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় উপহার দিয়ে বিভেদের দেয়াল তৈরি করে দিয়ে গেলেন। 

আজও পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এই চারকুচক্রী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের উত্তরসূরী বিভেদপন্থীরা পাহাড়কে কলঙ্কিত করে চলেছে। এই চারকুচক্রীদের সাথে মহাননেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা "ক্ষমা করা-ভুলে যাওয়া" নীতির ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনা করে পার্টির মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা কখনোই কম ছিল না। প্রয়াতনেতার "ক্ষমা করা-ভুলে যাওয়া" নীতির ভিত্তিতে আলোচনাকে এরা দুর্বলতা মনে করে সেদিন মিথ্যার আশ্বাসবাণী শুনিয়ে বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালে ১০ নভেম্বর প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে হত্যার মধ্যে দিয়ে সেদিন এই চারকুচক্রীরা প্রমাণ করেছিলেন, বিভেদপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল, বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকেরা জুম্ম জাতির কখনো আপন হতে পারেনা। আজ দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আমার কাছে সেটাই বাস্তব মনে হয়। কত বড় মহান এবং উদার মানুষ হলে প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষমা করে দিতে পারে, যার প্রমাণ স্বয়ং মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তাঁর নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন প্রতিক্রিয়াশীল কখনো আপন হয় না। তারপরও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রয়াত হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রতিক্রিয়াশীল গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রদের উৎখাত করে জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে একমূখী করে শাসকগোষ্ঠীর ভিত কেঁপে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীকে জনসংহতি সমিতির সাথে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের তিনটি রোলিং পার্টির সাথে আলাপ-আলোচনার পর সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পরবর্তী ইতিহাস অনেকেরই নখ-দর্পনে মধ্যে রয়েছে। শুরু হল আবারও নতুন করে জুম্ম জাতির ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। তাও দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে বিরোধীতা করে, নতুন করে-নতুনরুপে পূর্ণ-স্বায়ত্তশাসনের কৃত্রিম ফর্মূলা বানিয়ে জুম্ম জাতির কাছে দ্বিতীয়বারের মতন বিভেদের দেয়াল তৈরি করে শাসকগোষ্ঠী চুক্তি বাস্তবায়নের গনতান্ত্রিক আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে সফল হলেন। কিছু উচ্চাভিলাসী জুম্ম তরুণের শিশুসুলভ রাজনীতির অপরিপক্ক দৃষ্টিভঙ্গীর বহিঃপ্রকাশ হওয়ার দরুনই সেই শাসকগোষ্ঠীর ফাঁদে পা দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতোই পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করলেন। চুক্তি পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে কারা প্রথম বিভেদ সৃষ্টি করলেন এবং কারা বিভেদের সূত্রপাত ঘটালেন? এই অতি সাধারণ ও সাদাসিধে প্রশ্নটির উত্তর আপনারা না বুঝলে পাহাড়ের সাধারণ খেটে-খাওয়া জুম্ম জনগণের কাছ থেকে জেনে নেবেন। পাহাড়ের কিছু শিশুসুলভ রাজনীতি মানসিকতা সম্পন্ন জুম্ম তরুণদের লুফে নিয়ে এতদিন শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভেদের দেয়াল তৈরি করে আসছিল। ৯০ দশকেও জুম্ম জাতির সাথে শাসকগোষ্ঠী বিভেদের হোলিউৎসবে মেঠে উঠেছিল এক ঝাঁক বিপদগামী জুম্ম তরুণদের সাথে নিয়ে। সেই তরুণদের রাজনীতির অপরিপক্কতার সুযোগ নিয়ে শাসকগোষ্ঠী এতদিন চুক্তি বাস্তবায়নে অন্তরায় হয়ে থেকেছিল। শাসকগোষ্ঠী ফাঁদে পড়ে জুম্ম জাতিকে বিভক্তি, অনৈক্য, সংঘাত উপহার দিয়েছিল এই প্যারিস চাকমা, পলঙ চাকমার মতন নয়া ঐক্যপন্থী তরুণরাই। তাদের সেই অপরিণত রাজনীতির কারণে জুম্ম জাতিকে আজও কঠিন পরিস্থিতি মুখোমুখি হয়ে চলতে হচ্ছে। এই প্যারিস চাকমা ও পলঙ চাকমার মতন রাজনৈতিকগতভাবে অপরিপক্ক তরুণরাই সেদিন বিভেদের দেয়াল তৈরি করে শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের দ্বার উন্মোচিত করে দিয়েছিলেন। সেদিন সবাই যখন চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে আনন্দে নেচেছিলেন, খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলেন, দেশে-বিদেশে এই চুক্তিটি প্রশংসিত হয়েছিল তখন একদল প্যারিস চাকমা পলঙ চাকমার মতন তরুণ জুম্ম জাতির বুকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছিলেন। আজও সেই বিভেদ ও অনৈক্যের বোঝা জুম্ম জাতিকে বহন করতে হচ্ছে। শাসকগোষ্ঠী সেদিন যে ব্যুহচক্র রচনা করেছিল সেই ব্যূহচক্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল অনেক বিপদগামী জুম্ম তরুণ। তারমধ্যে প্যারিস চাকমা, পলঙ চাঙমারও এক একজন অন্যতম অনুচর।

আরও উল্লেখ্য যে, ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারী জরুরী অবস্থার সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিও একটি সঙ্কটকালীন মূহুর্ত অতিক্রম করেছিল। সংস্কারের তকমায় জাতীয় রাজনীতিকে যেমন কলুষিত করেছিল, ঠিক তেমনি সংস্কারপন্থী নামে শাসকগোষ্ঠীর নর্দমায় জন্মানো কীটপতঙ্গরা পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতিকেও দুষিত করেছিল। ঐক্যের ফেরিওয়ালাদের উদ্দেশ্য করে এটি মূলতঃ উল্লেখ করা নয়, বিষয়টি হলো এই সত্য ঘটনাগুলো আপনাদের পরিষ্কার করা দরকার মনে করি। জরুরী অবস্থার সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনীর অঙ্গুলি হেলনে "ভাগ কর, দুর্বল কর তারপর শাসন কর" এই নীতি কার্যকরী করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে। সেনা ডিজিএফআইয়ের হুমকির ভয়ে সন্তু লারমার বিরুদ্ধে পথে ঘাটে, দোকানপাটে প্রলাপ বকতে প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল। সন্তু লারমাকে মাইনাস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি হওয়ার লালসায় সুধাসিন্ধু-তাতিন্দ্র লাল চাকমা পেলেরা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি থেকে প্রকাশ্যে বেরিয়ে যায়। দলচ্যুত হওয়ার তিন বছর পর গঠন করেছিল ২০১০ সালে ১০ এপ্রিল সেনাবাহিনীর আর্শিবাদপুষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(এম.এন.লারমা) নামে একটি ভূঁইফোড় সন্ত্রাসী সংগঠন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নাম ব্যবহার ও তাঁর আদর্শকে বিক্রি করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতেই যারা মরিয়া সুতরাং তাদের কোন আদর্শের ভালাই থাকতে পারেনা। তারপরও জনসংহতি সমিতি সব সময় ঐক্যের পক্ষে, আন্দোলনের জুম্ম জাতির সামগ্রিক স্বার্থে সকল শ্রেণির সমাবেশ ঘটানোর পক্ষে যেমনি কাজ করে আসছিল তারজন্য আলাপ-আলোচনার দরজাও খোলা রেখেছিল। ভবিষ্যতেও তা হেরফের হবে না বলে আমি মনে করি।

প্যারিস চাকমার আরেকটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, তিনি বিভক্তি রাজনীতি করতে রাজি নন এবং বিভক্তি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে নাকি অনেক প্রস্তাব এসেছে। বিভক্ত রাজনীতি করতে যদি তিনি অরাজীই থেকে থাকেন, তাহলে ২০১১ সালে নিউইয়র্ক শহরে জাতিসংঘের কার্যালয়ের সকল জুম্ম ও আন্তর্জাতিক বন্ধুরা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আহুত বিক্ষোভ সমাবেশের সময় কেন ইউপিডিএফের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের বই বিলি করছিলেন? যাইহোক, বিভক্তি রাজনীতি না করলেও পাহাড়ের বিভক্তি রাজনীতিকে আরও অধিকতর খণ্ডবিখণ্ড করার জন্য বাক্যবান ছুঁড়ে দিচ্ছেন। আর বিভক্তি রাজনীতিতে আপনাকে কারা প্রস্তাব দিয়েছিল তা ভাল করে জানেন এবং এই মুর্হুতেও আপনাকে রক্ষার্থে বিশেষ দলের পক্ষে ফেইক আইডি থেকে যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব আসছে নিশ্চয়ই। বিশেষ দলের সেই যুক্তিসম্মত ও বাস্তব প্রস্তাবগুলো লুফে নিয়ে জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে আপনার অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করতে পারেন। 

তারপর পলঙ চাঙমা ফেইক আইডিতে উল্লেখ করেছিলেন, জুম্ম জাতীয় সংকট ও উত্তরণ প্রশ্নে কী বিষয়ে আলোচনা হওয়া দরকার? কোথায় আলোচনা হচ্ছে এবং কেন? লড়াইয়ে সমস্যা এবং আরেকটি লেখায় লিখেছেন, জেএসএস ও ইউপিডিএফ এর ঐক্য কতদূর? এভাবেই আপনি অনলাইন ফেসবুকীয় পোশাকি ঐক্যের ফেরিওয়ালা সেজে নিজেদের আত্মতৃপ্তির স্বাদ মেটাতে পারেন, কিন্তু ঐক্যের ধারেকাছেও যেতে পারবেন না। অপরদিকে বাক্যবান লেখনির খোঁচা সহ্য করার ক্ষমতা নেই আপনার। বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে লাভ শুধুমাত্র আপনার নয় লাভ হবে জাতির। সংগঠন করার স্বাধীনতা সবার আছে, কথা বলার স্বাধীনতাও সবার আছে। স্বাধীনতা তখনই উপভোগ করতে পারেন যখন আপনার মধ্যে শৃঙ্খলা মানতে পারার যোগ্যতা থেকে থাকে। কিন্তু তার আগে ভাবা উচিত হবে, জুম্ম জাতি এখনো অধিকারহীন, আমরা সংখ্যায় কম, যেহেতু জুম্ম সমাজ সবদিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর্থিক দিক দিয়ে অনুন্নত, লোক সংখ্যা অত্যন্ত কম এবং জন্মভূমিও ক্ষুদ্র, সেহেতু জুম্ম সমাজ সবদিক দিয়ে পরনির্ভরশীল। এমন নির্ভরশীল জাতি পৃথিবীতে খুব কমই রয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় চেতনার উন্মেষ ততটা উল্লেখযোগ্য নয়। জাতীয় চেতনার উন্মেষ উল্লেখযোগ্য ভাবে না ঘটলেও যেহেতু জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব আজ বিলুপ্তির পথে সেহেতু জুম্ম সমাজের বিরাট অংশ আজ জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা দরকার। 

আমাদের একমূখী আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করা দরকার। আপনি তো আরও একমূখী আন্দোলনের বিরুদ্ধে, বলেছিলেন একমূখী আন্দোলনের কারণে আমাদের চাকমা জাতি অনেক ক্ষতির শিকার হচ্ছে, ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নাকি বিকৃত হচ্ছে। আপনি এখনও একক চাকমা জাতির মধ্যে পড়ে আছেন, সমগ্র জুম্ম জাতি কোথায়? উগ্র আর সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মধ্যে পড়ে থাকলে আপনাকে পাহাড়ের মানুষ খুবই সমীহ করবে। মনে রাখবেন, আগায় পানি ঢাললে পানি গাছের গড়ায় ঠিকমত পড়বে না, আসল কথা হলো গাছের গড়ায় পানি ঢালতে হবে। অধিকার অর্জিত হওয়ার পর অনেক সংগঠন আপনি করতে পারেন। কিন্তু একটা জিনিস গভীরভাবে উপলদ্ধি করা উচিত, অধিকারহীন অবস্থায় এতোগুলো সংগঠন হলে আমাদের শক্তি ভাগ-ভাটোয়ারা হয়ে যায়, তখন শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আমাদের শক্তি দুর্বল হয়। সেজন্যই বলছি, এক মুষ্ঠিতে আঘাত করলে যতটাই শক্তিশালী হয় আর দুই মুষ্ঠিতে আঘাত করলে ততটাই দুর্বল হয়। তাই শাসকগোষ্ঠীকে এক মুষ্ঠিতে আঘাত করতে হবে। তারপরও যদি আপনি এ বিষয়ে অগভীর মনোভাব পোষণ করেন সেটা একান্ত আপনাদের বিষয়। জুম্ম জাতির অধিকার পেতে হলে শক্তিগুলো একত্রিত করতে হবে, খন্ড শক্তি দিয়ে বলি আওড়ানো যাবে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবেনা। কিন্তু কথা হলো এই শক্তিগুলো একত্রিত করতে গিয়ে আপনাদের মতন নয়া ঐক্যপন্থী আর পোশাকি ঐক্যের ফেরিওয়ালা সৃষ্টি হওয়ায় সেটাও আজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পর্দার আড়ালে থেকে শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছেন। আপনি স্বীকার করেন আর নাই করেন, জুম্ম জাতির এই বেহাল অবস্থার জন্য দায়ী কে? এটা যদি বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তব সম্মতভাবে বিচার বিশ্লেষণ করতেন তাহলে আসল উত্তরটাই এতদিন খুঁজে পেতেন। 

পরিশেষে আপনাদের লেখাগুলো পড়ে মনে হয় আপনারা ভূ-রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার জোনকে দখলে রাখার জন্য ভারত যেমন একুল-ঐকুল দুটোই কুল এতদিন রক্ষা করে চলেছিলেন। পরবর্তীতে চীনের কাছে সেটি নিছক যুক্তরাষ্ট্রের কুল রক্ষা হচ্ছে মনে করে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছড়ানোর জন্য চীনের এই ভারতের কালওয়ান ভ্যালীতে হামলা করেছিলেন। তাহলে আপনারাও কি সব সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান পরিস্থিতিকে জিইয়ে রাখতে দুই কুল রক্ষা করে চলবেন? গ্রামের একজন কারবারি বিচার করতে গিয়ে রায় দিতেন অভিযোগকারীকে বলতেন তোমারটাও ঠিক আর ভিকটিমকে বলতেন তোমারটাও ঠিক। এভাবেই সেই তথাকথিত কারবারি বিচারের কোন সমস্যার সমাধানই হয় না। আপনাদের ফেসবুক পোশাকি ঐক্যের ফেরিওয়ালাদের লেখাগুলোতে মনে হয় যেন সবকুল মেইনটেইন করে চলার সংস্কৃতি চর্চায় ব্যস্ত থাকেন। সত্য তো একটাই, সত্য দুটোই হয় না। ন্যায় অন্যায়ের মধ্যে ব্যবধান কমাতে না পারলে আপনাদের দ্বারাই জাতি কলঙ্কিত হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখকঃ দর্পন তঞ্চঙ্গ্যা

Comments


  1. পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘাত, চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ প্রভৃতি নানা অপরাধমূলক কর্মে শান্তির পাহাড় আজ নৈরাজ্যের নরকপুরীতে পরিণত করেছে উপজাতী সন্ত্রাসীদের ৪ টি সংগঠনের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। গণমাধ্যমে একে মৃত্যু উপত্যকা বলেও আখ্যা দিতে দেখা যায়।

    তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের একটাই দাবি, পাহাড়ের যে সকল জায়গা থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে সেখানে সেনা ক্যাম্প পুনঃস্থাপন করা হোক।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা আপনার মনগড়া দাবি। পাহাড়ের মানুষ শান্তির জন্য সেনাক্যাম্প পুনঃস্থাপন চাই না, চাই পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। সরকার পার্বত্য চুক্তিকে বাস্তবায়ন না করেই অশান্তির অনল জিইয়ে রেখেছে। এর দায় অবশ্যই সরকারকেই নিতে হবে।

      Delete

Post a Comment

Why?

Populer Post

পাহাড়ে অভাব,অনতন,বৈষম্য ও করোনা ভাইরাস:একটি প্রাসঙ্গিক ভাবনা| Tapan's Blog

একটি আদিবাসী মায়ের কান্না| Tapan's Blog